কেন এই পাতা

পানুর ইচ্ছা, লেখক হইবেন । বাঙালি, লেখক না হইতে পারিলে নমো নমো করিয়া পাতের সংস্থান যদি বা হয় জাত রক্ষা হয় না - যথা আঁটকুড়া কুলীন । পানু বিস্তর পরিশ্রম করিলেন । দিস্তা দিস্তা রচনাবলী, অমনিবাস চিবাইলেন । প্রথমে কাব্য টানিয়াছিল, কারণ রস - রসে পাঁউরুটি ভিজিল না । পানু ঘটা করিয়া কিছুদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখিলেন (ভেঙ্গেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতিরম্যায়, আট হাজার বাষট্টি টাকার দরজা, খর্চা কে দ্যায় ! অথবা, কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া, চৌমাথার মোড়ে দিব পেন্টুল খুলিয়া) হাউ হাউ করিয়া লোকে মারিতে আসিল । সমস্ত অবজ্ঞা করিয়া পানু লিখিয়া চলিলেন । যদ্যপি পানুর কলমের তোড়ে কাব্যলক্ষী কোঁ কোঁ, সম্পাদকের দপ্তরে চিঁড়া ভিজিল না । অতঃপর পানুর দুঃখে ব্যাবেজ সায়েব কম্পিউটার আবিষ্কার করিলেন । বাজারে ব্লগ আসিল । পানু ব্লগার হইলেন । এই পাতা পানুর পাতা । যা তা ।

Saturday, June 25, 2011

ব্র্যাকেটশহর ( নতুন অংশ)

প্রভু নির্জ্ঞান কী ?
-- নির্জ্ঞান একটি কুয়াশা
প্রভু, প্রজ্ঞা কী ?
-- প্রজ্ঞা একটি কুয়াশা
প্রভু, তবে নির্জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পার্থক্য কী ?
-- নির্জ্ঞানের নিজস্ব আছে এক অন্ধকার । প্রজ্ঞার অন্তর্বর্তী এক আলো – যা কুয়াশাভেদে অক্ষম ।
এই সেই আলো যার অর্জনই একমাত্র হেতু । এই সেই আলো যা ব্যবহার্য্য নয় ।

এর পর ভোর হয়
উদ্যোগ নড়ে চড়ে ব্র্যাকেটশহরে
ফল ব’লে আর কিছুই
বাগানে বাজারে পড়ে থাকে না ।

যা নেই তা’ই চিহ্নক – চিহ্নিত বস্তুসমূহে যার আকাঙ্খাটুকু দেখা যায় ।

Tuesday, June 21, 2011

হনন

উদ্যত উদার কুঠার
কব্জির গাঢ় সঞ্চালন
নিগূঢ় নিবিড় প্রিয় পাপ
কপালে ছোঁয়াই সযতন

(না-কী) সেও থাকে হোথা অকৃপণ
সেও ভাসে দ্বিধাহীন জলে
আমিও ভেসেছি অনিবার
আজীবন কুয়াশার ছলে

রজ্জুযোগে সর্প রাখি ঘরে
কান্ধে কেতু নয় রন্ধ্রে শনি
বিবেকের কক্ষে পুষি বিছা
হননের আমি কীইবা জানি

সুন্দরবন ও গুয়ের্নিকার মধ্যবর্তী রেলস্টেশানে নেমে পড়েন প্লেটো ও ট্রেনের জানলাসমূহ । অইখানে ভীতি – ভীতির অন্তরালে সপ্তদশ শতাব্দীর কালো টেলিফোন, গরম জলের ব্যাগ, টায়ারের চটি, কবি-তকমা ঝেড়ে ফেলা ইথিওপিয়ার বন্দুক ব্যবসায়ী এবং বহুপ্রচলিত অনুকম্পায়ী রাত্রি । এরপর ধাতুর ঝরনার সাথে ক্রমাগত শুভেচ্ছা বিনিময় করতে থাকে আমাদের অবদমন আর সেই কর্কশ ঝমঝমের ভেতর স্পষ্ট হয়ে ওঠে বন্দুক ব্যবসায়ীর উচ্চারণ – শিথিলতার অব্যবহিত আগে যে বিস্ময় – সে’ই হনন । বলাই বাহুল্য, সেই সময় রবি, আমাদের রবীন্দ্রনাথ, চতুর্দশবর্ষীয় এক বালক মাত্র । আর ব্যাখ্যা, ঘাতকের মানেবইগুলো নীলাভ এক দ্যুতির মধ্যে ঘোরাফেরা করে, নিজেই হারিয়ে যায়, ফিরে আসে – যন্ত্রণারহিত । এক স্বপ্নভঙ্গের নোটিশ আমাদেরও প্রাপ্য হয়ে ওঠে । এই সেই আলো যা ব্যবহার্য নয় । এই সেই প্ররোচনা যা বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য নয় । এই সুস্থতা, এই হত্যা ।

Sunday, June 19, 2011

ব্র্যাকেটশহর (নতুন, অংশ)

শব্দ স্পর্শ করে লেখা ভরা যোনী
স্পর্শের ঘরে ঢোকে সাপ
সাপের মর্মে থাকে “অতঃপর” ধ্বনি
ধবনির অন্তরালে ......

ব্র্যাকেটশহর – এই এক ভাস্বর মদ
যার নেশা পাথর-কুঁদিয়ে হয়ে ওঠে
আগলায়, ঠোকরায়
লিরিকের গলিতে বিশ্বাস বর্জন করে
সর্বাঙ্গ কড়া নাড়ে
অভিব্যাক্তি ছাড়াই
ঢুকে যায়
নিরীক্ষায়
দাঁতে
প্রমায়

কোন কিছুই আর পড়ে থাকে না
তবু “অতঃপর” উপচিয়ে ওঠে

এরপরও প্রয়োজন হয়
প্রামান্য পথ,
কুয়াশা ও
সেবাসদনের মত সায়া
দু’খুঁটির মাঝে ঝুল খাওয়া
মৌসুমির হেতু

কলি থেকে ফিরে

আলোক সরকার বললেন – “আমি ওই সুধীন্দ্রনাথের কথাটা মানি— আবেগ কবিতার শত্রু” । মানি আমিও, নিতান্ত অবশ্য করে – কিন্তু প্রবলেম হল –যত আবেগ লেখা থেকে ঝেঁটিয়ে তাড়াই-- সব গিয়ে জমা হয় চরিত্রে । ফলে একটা গোটা দিন চোখে যাকে বলে আনন্দাশ্রু-টাশ্রু নিয়ে আবেগে বোকা বোকা কথা বলে গেলাম। প্রতিবার ভাবি, আর নয়, বয়স হচ্ছে-- বয়স হলে কাচা-কোছা ছোট হতে থাকে । ১৩ তারিখ সুদেষ্ণার বাড়িতে বসা হয়েছিল, সুদেষ্ণার ভাই স্বর্ণেন্দু, ভাতৃবধু, ও ভাইপো ভুতুম – যে কী না এক নির্মল জিনিয়াস । সে মহাভারত পুরো জানে । সে জানে অজ্ঞাতবাসে যুধিষ্ঠির, কঙ্ক নামে বিরাট রাজসভায় ... আর তার কত বাহা রে প্রশ্ন – একটাই দোষ – ছেলে বড্ড রোগা । ভুতুমের সাথে ভালো ভাবে আলাপ জমাতে জমাতে এল শুভ্র । খানিক্ষন আড্ডা চলতে চলতেই, নিজেকে আমাদের কাছে নিয়ে এল অনুপম —পিঠে গীটার । আর তার পর ! শুধু গান ! এই অসম্ভব গানের পর আর কবিতা/গদ্য পড়ার কথা মাথায় আসে না-কী ! ডায়েরী খুলে – প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে-- গান । মাঝে সাঝে সুদেষ্ণা, স্বর্ণেন্দুর রচিত প্যারোডি (স্বর্ণেন্দু একজন ভাল গদ্য-লিখিয়েও বটে) । অনুপম একজন অনুপম, অসম্ভব বিনয়ী সারস (নাহ একদম ঢ্যাঙ্গা নয় সে), গানের শুভ্রতায় সারস । কানে এখনো বাজছে “গাইনেশিয়াম”, “গভীরে যাও” । দাদা’রা এ ছেলের স্টকে আরো কত যে ব্লকবাস্টার আছে ! মাঝে দুরন্ত খাওয়া দাওয়া-- সুদেষ্ণা রাত জেগে মুরগী ম্যারিনেট করেছিল না মুরগী সুদেষ্ণাকে সেটা ক্লিয়ার হল না । তবে, ঐ কষা চিকেন খাওয়ার পর ঠিক করেছি – রেসিপিটি জানতেই অইব । ভাঙ্গা মাছের কী একটা পদ ছিল, আমি জানি না, শুভ্র জানে – মানে আমি মাছের শত্রু, মাছ আমার, আর আমি শত্রুর মাংস খাই না । তারপর আবার গান, একদম শেষে সবার অনুরোধে—আমাকে আমার মত-- ৫-টার সময় – অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে পড়া একটু (গোটা ৬য়েক) রসগোল্লা খেয়ে । উঠে মাণিকতলায় কৌরবের বই দোকান –বইকুন্ঠে – সেখান থেকে বেশ কিছু বই তুলে – কফি হাউস । অনুপমের মাথা ব্যথা ফলে ও বইকুন্ঠ থেকেই বাড়ি । কফি হাউসে দেখা করার কথা ছিল বারীন-দা আর কমল-দার সাথে, কিন্তু সকাল থেকেই পান ভোজনে শরীর বিট্রে করছিল আর মোবাইল ফোনের অকথ্য সার্ভিসে প্ল্যানিং বিগড়ে – কিছছু বুঝতে না পেরে ৮-টায় বাড়ি রওনা দিলাম । মাঝরাস্থায় বারীন-দা জানালো ওঁরা কফি হাউসে । পেছনে অকথ্য জ্যাম-- ফেরা হল না । এক কাঁড়ি আফশোস হল – জানতাম বারীন-দা খিস্তি করবে – ভালোবেসে যতটা খিস্তি করা যায় (ভালোবেসেই সবটা খিস্তি করা যায় আর কী ) । বারীন-দা সরি – কান মুলছি, এক হাট লোকের সামনে এই নিল ডাউন হলাম ।

১৪ তারিখ নতুন সকাল । রাজা রামচন্দ্র রায় বিদ্যালয়ে রক্তদান শিবির চলছিল, বাইরে তখনও রোদ । সুদেষ্ণা আর শুভ্র ভ্যাম্পায়ারের মত ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল । একত্রে এর পর হালতু । আলোক সরকারের বাড়ি । না না কাজের কথার মধ্যে আড্ডা, বৌদি মিষ্টি দিয়ে যান – সুদেষ্ণার ডায়াবিটিস, তবু মুখ মিষ্টি করতে মিষ্টি খায় । আলোক দা তারমধ্যেই জীবনানন্দ-র কথা বলেন – “জীবনানন্দ আমার অব্যবহিত শত্রু” – নাহ এ’কথার মধ্যে ক্ষুদ্রতা খুঁজতে যাবেন না – এ নিজের একান্ত নিজস্ব লেখা তৈরি করার জন্য, নিজের পথ বেছে নেওয়ার জন্য একমাত্র টোটকা—যার প্রভাব এড়ানো কঠিন মনে হচ্ছে তাকে অস্বীকার কর প্রয়োজন হলে শত্রু বানাও । তা আলোক সরকার সেই কবে থেকেই সফল । পঞ্চাশের “কৃত্তিবাসের” আবেগ, উন্মাদনা, জনপ্রিয়তা-র পাশে, কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই সম্পূর্ণ নিষ্ঠায় কবিতা করে যাওয়া, বাংলা কবিতাকে ক্রমাগত ঋদ্ধ করে যাওয়া আলোক-অলোকের “শতভিষা” আজ বাংলা কবিতার জগতে “কবিতা/পরিচয়” পত্রিকার মতই অন্যতম মূল্যবান । আলোক সরকারের কী পচাশি হল ? এখনো তিনি সমান সচেতন, চারিপাশে নতুন যারা লিখছে তাঁদের লেখার প্রতি দারুণ আগ্রহ । এখনো তিনি নিজের লেখার বদলের কথা ভাবেন । প্রচুর কথা হল রবীন্দ্র গান নিয়ে—একেকটি গান, তাঁদের ব্যাকগ্রাউন্ড, এলেন বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে – আমি ৪০-এর কবিদের মধ্যে এই মুহুর্তে আমার একমাত্র ভালো লাগা কবি অমিয় চক্রবর্তীর লেখা নিয়ে নিজের উচ্ছাস প্রকাশ করতে বললেন – হ্যাঁ, অমিয় চক্রবর্তীই হয়ত ঐ জেনারেশানের আজ একমাত্র প্রাসঙ্গিক কবি । আমি কী করলাম ! আবেগে আবারো হাজার বাজে কথা বলে গেলাম ।
বেরোনোর আগে আলোক দা ডাকলেন, সুদেষ্ণা, শুভ্র তখন বৌদির সাথে কথা বলছে । বললেন – “কাল লিখেছি একটা কবিতা, ব্যাপারটা এরকম – একটা নিশ্ছিদ্র হলুদ রঙ, জমাট হয়ে আছে , তার ভেতরে কিছু নেই, মানে শুধু নেই-টুকু আছে, সেটাও তো একটা থাকা – ধরতে পারছ ?” একদম পারি আলোক দা, আপনার ভাষায় – “অভাবের কাছে ফিরি” । কবিতায় আবেগ রাখি না এখানে রাখলাম ।

আলোকদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এবার বারুইপুর, এবার শুভ্রর বাড়ির দিকে । পথে যে খানটায় চা খেলাম সিগারেট কিনলাম সেখানেই মুখার্জী কুসুম ফুটেছে – শেরউড এস্টেটে রবিন হুড থাকে না, শংকর লাহিড়ী থাকেন । ফ্ল্যাট নং মনে ছিল না, টেলিফোন নাম্বারও ফোন বদলিয়ে হাওয়া । ভেবেছিলাম একবার ঢুঁ মেরে নেব – হল না ।
শুভ্রর বাড়ি পৌঁছেই দেখি, কাকীমা বসে আছেন – বললেন খেতে বসে যাও । ওফ ! সে-কী রান্না ! শুক্তো, পোস্ত চিংড়ি আর সর্ষে-ইলিশ । আমার মাছের সাথে শত্রুতা ছোট বেলা ইস্তক, এখন মাঝে সাঝে বেলে, কাজরী, পাবদা – কিন্তু ইলিশ ! ভয়ংকর ! ছেলেবেলায় ইলিশ খাইনি গন্ধে – তারপর গন্ধ ভাল লেগে যাওয়ায় ঝোল অব্দি দৌড়, কর্ণে শোনা – ব্যাপক কাঁটা । কী ইচ্ছা হল জানি না – চিংড়ি শেষ করে ইলিশে হাত দিলাম আর আহা ! এরকম জিনিস এত বছর উদ্গান্ডুর মত অগ্রাহ্য করে এসেছি ! (আমি বাঙাল তো ছিলামই, এই প্রথম মোহন-বাঙাল) সঙ্গে সঙ্গে ফোন বাড়িতে – বৌ’কে সমাচার । মা, বাবা বেঁচে থাকলে খুশী হত, নিশ্চিত । আঁচিয়ে শুভ্রর ঘরে – প্রথমে বই দেখা – বিশাল কালেকশান ! জমিল সৈয়দ পড়লাম – অপূর্ব লেখা । আর শুভ্রর সবচেয়ে মূল্যবান – যা ভবিষ্যতে মিউজিয়ামে রাখা যায় – উৎপল কুমার বসু-কে উপহার দেয়া কমপক্ষে দশজন বিভিন্ন লেখকের বই – তাঁদের সই বার্তা সমেত, এমন কী দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়-এর উপহার, সেই বই-এ দেবদুলালের নিজের হাতের নোটস, প্রবুদ্ধ সুন্দর কর, অভিজিৎ মিত্র, ইত্যাদি...। উৎপলের বাড়ির বাইরে ফুটপাথের বইওলার কাছে কেনা । এই মূল্যবান প্রকল্পে সঙ্গী হতে আপনারা নিজের নিজের বই উৎপল বাবুকে উপহার দিতে পারেন – আমরা পরের দিন তা ফুটপাথ থেকে নাম মাত্র দামে কিনে নেব এ গ্যারান্টি দিলাম । আর পেলাম হুলিও কোরতাজ – অসম্ভব ! যে বদমাইশি বুদ্ধিগুলো আসে – ভাবি অভিনব – ১৯৬৫তে বসে ভদ্রলোক সব করে গেছেন, কিচ্ছু বাকী নেই ।

চা খেতে খেতে এরপর শুভ্রর গদ্য । বাইরে মৌসুমি-দি জানান দিচ্ছেন তিনি আসছেন । শুভ্রর ভাষায় সুর্য-দা জাঙ্গিয়া ছেড়ে ওভারকোট পরেছেন । আর ঘরে শুভ্রর গদ্য । শুভ্র বৌদ্ধলেখমালা ফিনিশ করে, গদ্যে হাত দিয়েছে, একসাথেই চলছে দুটি গদ্য (তার মধ্যে একটি উপন্যাস, হাতে লেখা, একটা শব্দও কাটাকুটি নেই-- ভাবা যায় ! আর কেমন গদ্য ! হলফ করে বলতে পারি—এই গদ্য লেখার পাটা খুব কমের-- বাঙালির শুধু নয়, পৃথিবীর । এরি মাঝে শমিতের ফোন আর আমাদের অনেক আফশোস দেখা না হওয়ার । আবার গদ্য ! ওহ অনবদ্য ।

মণীন্দ্র গুপ্তর সাথে দেখা করার ছিল – হল না । দেবারতি-দি (মিত্র) একটু অসুস্থ , মনীন্দ্র বাবু তাঁকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে ।

৫টার দিকে আমি আর সুদেষ্ণা ফেরার রাস্তায় । আমাকে কল্যানী ফিরতে হবে, সুদেষ্ণা সিঁথি মোড় । গোটা রাস্তা চুপচাপ, আবার কবে একসাথে আমরা সবাই ! রাস্তায় এগরোল
তারপর শিয়ালদহ ।

১৫ তারিখ সাগরনীলের সাথে বসার ছিল আর এক অম্লান বন্ধুর সাথে ! হল না – এ যাত্রায় । আফশোস ! আফশোস !

Saturday, June 4, 2011

শ্লীল/অশ্লীল, নান্দনিকতা, স্টিরিওটাইপ, ভূকাব্যিকতা

শ্লীল/অশ্লীল, নান্দনিকতা, স্টিরিওটাইপ, ভূকাব্যিকতা:

শিরোনামে, গেঁটে-বাতও জুড়বো ভেবেছিলাম, সামলে নিলুম । ভেবেছিলাম একটা নিউট্রাল জায়গা থেকে শুরু করব – জাফর (বাহাদুর শাহ) বা গালিব (আসাদুল্লা খান) – মানে এর চেয়ে নিউট্রালি ভালো লাগার জায়গা বাঙ্গালির আর এক ঠাঁই – রবীন্দ্রনাথ, তা তিনিও আসবেন, ঘুরে যাবেন । প্রথমে কন্ট্রোভার্সিটি থেকেই শুরু হোক । একটা কবিতা – অবধারিত ভাবে পানু’র লেখা ।

হে মস্ত ও দুলন্ত শহর
কখনো ভাবিনি আগে
প্রকৃত ভোরের বেলা
শুধু ভোর বেঁচে থাকে
মানুষের মাথার ভেতর

ছেলেটি সাধারণ দেখতে, মেয়েটিও
মাঝখানে অনিশ্চিত ঘুরে বেড়াচ্ছিল – ভালোবাসা
মেয়েটি বলছিল – যদি কোন ঈশ্বর থাকে, তার বাস নির্ঘাত কোন শরীরের
অন্তঃস্থলে নয় – দুজনের মাঝের ভরাট শুন্যতায়

শুন্যতায় কে থাকে ? কার স্যাক্সোফোন
বেসমেন্টের জানলার ফাঁক গলে
তাজা রসুণ রুটির গন্ধ
ছেলেটি ও মেয়েটি এক পাক নেচে নিচ্ছে
ছেলেটি শুতে চেয়েছিল, মেয়েটি চায়নি
কামনা নিপাট ছিল – তবু
আমরা ভাবছিলাম,
ভাল হত যদি ওরা চুদত
তীব্র ও অনুকম্পাহীন
ভাল হত যদি ওরা চুদত
ঘরোয়া ও লাম্পট্যময়

আসলে ঝাঁপ দুরকম হয়
দৃষ্টির সামনে ও পিছনে
বৃষ্টি হয়নি
জলের গাড়ি ফুটপাথ ধুয়ে চলে গেছে
আমাদের প্রত্যেকের সামনে একটি স্টেশান চত্বর
মৃদু ও সবুজ ছাদ
লাল ও নিষেধী দেয়াল দরোজা

ফাঁদের মধ্যে কেবল আরো একটি ফাঁদ – এই বুনোট
আমরা যারা শুধুমাত্র একটি ঝাঁপের জন্য প্রস্তুত হই
ঘাড় গুঁজে টিউশানি পড়ি, অভিধান খুলে বার বার
ধাতস্থ হই – আর যাই হোক
ঝাঁপ শব্দটির নীচে পাতা অন্ধকার
অবিকল আগের মতন প্রগাঢ় ও প্রতিশ্রুতিময়

আঁতকে উঠে বন্ধ করে দেবার আগে, পুরোটা শুনতে জাস্ট একটা অনুরোধ করব, মাউস আপনার হাতে । ২০০৭-এর মাঝামাঝি পানু’র লেখা বন্ধ হয়ে যায় – রাইটার্স ব্লক, (মহাকরণের সাথে সম্পর্ক নেই) । হতাশ পানু নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে । লেখার জগত থেকে, বন্ধু বান্ধব থেকে । একদিন রাতে “বিফোর সানরাইজ” বলে একটা ইংরেজী সিনেমা দেখতে দেখতে লেখাটি আসে । পানু তার প্রিয় মঞ্চে লেখাটি তৎক্ষণাৎ শেয়ার করে । লেখাটি পাতে পড়তে না পড়তে জনগণ আঁতকে ওঠেন (অনুমান) ও প্রতিবাদে ফেটে পড়েন (প্রত্যক্ষ) –" মঞ্চ কলুষিত করতে এসেছেন, রাস্তার ভাষা নিয়ে রাস্তায় যান" ইত্যাদি... প্রভৃতি ... কেউ কেউ মৃদু তিরষ্কার করেন এত সুন্দর এই লাইনগুলো, এর মাঝে একটা এরকম শব্দ ! এ-কী রুচি ?
বন্ধুরাও আসেন । শ্লীল। অশ্লীল নিয়ে এক তুলকালাম হয় । পানু কোন তর্ক না করে, মাথা নীচু ক’রে সরে পড়ে । পানু-কে জিগ্যেস করলাম -- কী পানু, উদ্দেশ্য কি ছিল ? বোম ফাটানো ? না-কী বহুদিন পিঠ সুড়সুড় । পানু বলল-- কোনটাই নয়, জাস্ট ওর থেকে অ্যাপ্রপ্রিয়েট কোন শব্দ পাইনি । এক রাত্রে দুটি ছেলে মেয়ের সাক্ষাৎ, আলাপ, আকর্ষণ, সান্নিধ্য – পরের দিন সকালে দুজনেই চলে যাবে নিজের নিজের জায়গায় – পানু বলল ওরা চাইছিলো কিন্তু শারীরিক হতে পারছিল না – আমার মনে হচ্ছিল ওরা যদি একবার শুয়ে পড়ে তাহলে হয়ত দুটি তরুণ তরুণীর দীর্ঘ ভবিষ্যতের কোন যন্ত্রণা থাকবে না – দে মে গেট ওভার ইচ আদার অ্যান্ড মুভ অন । এত সংক্ষিপ্ত সময়, রাত শেষ হয়ে আসছে এই অবস্থায় যে কোন বিকল্প শব্দ – করতো বা শুতো (অনিশ্চিত যা বহু ক্রিয়াকে মীন করতে পারে), রমণ, গমণ, ভালোবাসাবাসি (এর সাথে “করা/ করতো” কে রেখে প্রলম্বিত করা), খাপ খায় না বলে মনে হয়েছিল । একমাত্র “চুদতো”-ই এই ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ও অ্যাপ্ট । তো এখানে রুচি ম্যাটার করেনি বররুচিও নয় ।

প্রশ্ন হলো জনগণের কেন এই ইনহিবিশান ? (জীবনে ছেড়েই দিন) গল্পে, কবিতায়, সাহিত্যে পরকীয়া (বিবাহিত পিতৃবন্ধু কাকুর সাথে মনুমেন্টের মাথায় উঠে প্রেম করলেও অ্যাওয়ার্ড মেলে) বহুদিন বাঙালি ধরেছে, মরালিটির তোয়াক্কা নেই – তো মানুষ পরস্ত্রীকে রমণ, গমণ, প্রবেশ সব করতে পারে, কথ্য ভাষায় সমস্ত কিছু বলতে পারে আর নিজের বৌয়ের সাথে লিখিত ভাবে চুদতে পারবে না ? কেন এই ইনহিবিশান ? কেন এই কথ্য আর লিখিতের বিভেদ ?

পানু বিস্তর গবেষণা করিল – জ্ঞানী, গুণীর লেখা পড়ে বললো – বাঙালি তথা ভারতবাসীর মহারাণী ভিক্টোরিয়া নির্মিত মরাল কোড অফ কন্ডাক্ট (চন্ডীদাস/ ভারতচন্দ্র আপনারা মশাই যা-তা, কালিদাস তো অকথ্য – পানু অপেক্ষা পানু), আর বাঙ্গালির ক্ষেত্রে রাবীন্দ্রিক ভাষার চাপে, হুতোম, ত্রৈলোক্যনাথের (মুখোপাধ্যায়) ভাষার অপমৃত্যু – যদ্যপি অতিমানব রবীন্দ্রনাথ নিজের ভাষাটি নিজের লেখার জন্যই নির্মাণ করেছিলেন এবং মহীরূহ মাফিক অনুদার ছিলেন না । ত্রৈলোক্যনাথের ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া পরশুরামের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন – হুতোমেও তাঁর শ্রদ্ধা ছিল । বাঙালি (পড়ুন আকাদেমি) রবীন্দ্রনাথ কে চিনলো না, সে নোবেল চেনে, তদুপরি বেল চেনে – ফলে কোন তলায় সুবিধে ... ইত্যাদী, প্রভৃতি...। আর এখন তো আনন্দ হি আনন্দ – সেখানে যা হবে তাই রীতি, তাই গীতি – পড়তে হয়, না পড়লে বিলা ! সেন্স অফ অ্যাস্থেটিকস পুরোপুরি বানিজ্য নির্ভর । প্রমাণ চান ? বকফুল উৎপাদন শুরু করুন, প্লেটে বকফুল, শ্লেটে বকফুল, তারায় তারায় বকফুল, জলসায় বকফুল, খোঁপায় বকফুল, ফ্লেবারে বকফুল – বকফুল কোম্পানি পিভিটি লিমিঃ, ডজন খানেক সাহিত্যিক ভাড়া করুন, রাজনৈতিক নেতাদের বকফুল খাওয়ান ( সঠিক মুদ্রায়) দশ বছরে লোকে বলবে – আহা বকফুলের মত গাল, বকফুলের মত চোখ, বকফুলের মত গলা ...

মানুষ ভয় পায় আইসোলেশান, আইসোলেশান নিরাপত্তায় আঘাত করে । নান্দনিকতার কোন সার্বজনীন সংস্করণ হওয়ার কথা তো ছিলো না । সে তো সাব্জেক্টিভ, তবু কেন সে সার্বজনীন ঐক্যের ধার ধারে ? বাণিজ্য ।

তো এইবার আসা যাক নিউট্রাল জোনে – অনুবাদ দিয়ে শুরু করা যাক – কারণ, অনুবাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য আক্ষরিক ভাবে অবজেক্টিভ প্রক্রিয়ায় একটি লেখার ভাষান্তর । কিন্তু সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের ভাষা আলাদা ! কেলোয় ফরসা ! পানু স্কুলে থাকতে একদা বাহাদুর শাহ জাফর অনুবাদ করেছে । এখন পানু পাড়ায় দাদা, মাথাটি একিরকম থাকলেও পানু এখন মাথা খাটায় না, মগজবাজি / মগজমারী করে । পানুর ভাষা এখন বুলি, তার পারমানেন্ট ঠিকানা পতলি গলি -- তো পানু’কে বললাম আর একবার পিছনে না তাকিয়ে অনুবাদ কর । তো পানু, ছাক্কা ৪৫ মিনিট ধরে লিখে কাগজ দিলো ।

বাহাদুর শাহ জাফর / ন কিসী কী আঁখ কা নুর হুঁ (ওরিজিনাল)

ন কিসি কী আঁখ কা নুর হুঁ, ন কিসি কে দিল কা করার হুঁ,
ন কিসি কে কাম আ সকে, ম্যয় ওহ এক মুশথ-এ-গুবার হুঁ ।

ম্যয় নহীঁ হুঁ নগমাঁ-এ জাঁ-ফিজা, কোই সুন কে মুঝ কো করে গা কেয়া ?
ম্যয় বড়ে বিরুগ কী হুঁ সদা, কিসি দিল-জলে কী পুকার হুঁ

মেরা রঙ রূপ বিগড় গ্যয়া, মেরা ইয়ার মুঝ সে বিছড় গ্যয়া,
জো চমন খিজাঁ সে উজড় গ্যয়া, ম্যয় উসি কী ফসল-এ-বাহার হুঁ ।

ন তো ম্যয় কিসী কা হবিব হুঁ, ন তো ম্যয় কিসী কা রকীব হুঁ,
জো বিগড় গ্যয়া ওহ নসীব হুঁ, জো উজড় গ্যয়া ওহ দায়র হুঁ ।

হম পর ফাতেহা কোই আয়ে কিঁউ, কোই চার ফুল ছিড়ায়ে কিঁউ ?
জাফর, আশক কোই বহায়ে কিঁউ, কে ম্যয় বেকসী কা মজার হুঁ ।


পানুর অনুবাদ (সত্যযুগ)

কারো আঁখিপাতে জ্যোতি নই আমি, কোনো হৃদয়ের শান্তিবাসর,
কারো প্রয়োজনে আসি নাই কাজে, শুধু এক মুঠি ধুলির চাদর ।

কোনো অপরূপ গুঞ্জনরেশ, নই আমি নই, কী হবে শুনিয়া ?
আমি শুধু এক ক্রমার্তনাদ, প্রসবিত হই কলিজা পুড়িয়া ।

আনন জ্যোতি, প্রিয়মুখ যত, আঙ্গন ছাড়ি হারায়ে গিয়াছে,
আমি ঝরাফুল বসন্ত বনে, যে বনে বাহার বিদায় নিয়াছে ।

কোন হৃদয়ের হৃদয় নই গো, কোন শত্রর দুশমন ঘোর,
আমি বিমূর্ত দগ্ধভাগ্য, স্পন্দনহীন, মৃত সরোবর ।

কেউ কেন দিবে দু’টি ঝরাফুল, অশ্রু অর্ঘ্য আমার শিয়রে,
অসহায়তার ইতিহাস হয়ে, জাফর মুছিবে কালপ্রান্তরে ।

পানুর অনুবাদ (ঘোরকলিযুগ)

কারোর চোখের রোশনি নই বে
বুকের শান্তি
কারোর কাজে লাগিনি , শালার
ধুলোর মুঠঠি

জান ভ’রে দেয়া মিউজিক নই
শুনবে কে বাপ !
ফাঁকা গাম্বাট আওয়াজ, পোড়া
কলজের ডাক

থোবড়ার ফ্রেশ, ইয়ারের ফেস
লোপাট হয়েছে
শুখা ফুল আমি, ফাঁকা বাগানের
ইয়ের নীচে

কোনো হারামীর দুশমন নই,
জিগরি ইয়ার
ফুলস্টীম-- পোড়া কপাল, শুকনো
নদীয়া’র পার

কোন রঙ্গিলি ফাতেহা পড়বে
আমার কবরে ?
ফুল দেবে শালা জাফরের, ক’টা
হোপলেস হাড়ে ?


(দ্রষ্টব্য ; লাস্ট দু’লাইনে পানু “ এই হোপলেস গাঁড়ে” লিখেছিল, আমি “হাড়ে” করলাম, যদিও পানুর বর্তমান ভোক্যাবে হাড্ডি আছে, হাড় নাই – নান্দনিকতার খাতিরে, মানে, আত্মীয় স্বজনের নান্দনিক ভ্রুকুটির কোপে, রবীন্দ্রনাথকেও এককালে “ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো / আমার বুকের বসন খানি” কেটে “মুখের আঁচল খানি” বসাতে হয়, যদ্যপি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে মহিলারা হাসাহাসি করেন, অ্যাস সাচ মুখে আঁচল থাকে না, থাকলেও সেটা ন্যাচারাল পোজ নয়, তদুপরি, হাতে ধরে থাকার জন্য ওড়া বেশ দুষ্কর – বুকের বসন সেখানে উড়ে যাওয়া— বলাকার মত অনায়াস ঝামেলাবিহীন । তথাপি... ইত্যাদি, প্রভৃতি...)

পাঠক, আর একবার রেগে ওঠার আগে মনে করিয়ে দিই –অশ্রদ্ধা উদ্দেশ্য নয়, জাস্ট ওয়ান্ট টু মেক আ পয়েন্ট ।

এবার আরেকটা সিনারিও – এবার গালিব – গদাই, কলকাতার বিজয়গড় অঞ্চলে থাকেন । সবে এক জেনারেশান বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, গদাইয়ের পাড়া পড়শী, বন্ধু, বান্ধব যে ভাষায় কথা বলেন সে ভাষা এখনো বাংলাদেশের ছোঁয়া বজায় রেখেছে –

গালিব ( ওরিজিনাল)

হরেক বাত পে কহতে হো তুম
কে তু কেয়া হ্যায় ?
তুমহি কহো --
ইয়ে অন্দাজ-এ-গুফতগু কেয়া হ্যায়

রগোঁ মে দৌড়তে ফিরনে কি
হম নহী কায়ল
জব আঁখ হী সে ন টপকা তো ফির
লহু কেয়া হ্যায়

অনুবাদ (গদাই লস্কর)

হগল কথায় জিগাও – তুমি কে-ডা
তুমিই ক’ও
এ কী ধরণ কথার ?

শিরার মইদ্যে হুলুস্থুলুস-- দিগবিদিকা সোটে
(তারে) খুন কই না মোটে
চক্ষু দিয়া না’ই যদি বয়
রক্ত সে-ডা ?

--
কী পানুর কলিযুগের অনুবাদ পড়ে ব্লাড বয়েলিং, আর গদাইয়ের অনুবাদ পড়ে কমিক কমিক ফূর্তি হচ্ছে তো ? জজসায়েব – দিস ইজ স্টিরিওটাইপ । ভাষার নয়, মাথার । রকের ভাষায় বাওয়াল হবে, তার নান্দনিকতা থাকার অধিকার নেই । ভানু বন্দোপাধ্যায়ের সুবাদে বাংলাদেশের কথ্য ভাষা কমিক ছাড়া আর কিছু নয় । পুরুলিয়া / বাঁকুড়ার ভাষায় বড়জোর গলা কাঁপিয়ে আবৃত্তি করার মত মানুষের দূরবস্থা, দৈন্যর প্রকাশ সম্ভব । ইন্টেলেকচুয়াল / নান্দনিক কিছু লিখিত ভাবে রাবীন্দ্রিক বাংলা ছাড়া মহাপাপ ।

এবার সত্য নান্দনিক টেরিটোরিতে একটু ঢুঁ মারা যাক । পানুর আলম বালম ছেড়ে, ভূকাব্যিকতায় । সেই ছোটবেলায় পড়া – পশুকে বন থেকে তুলে আনা যায় কিন্তু তার মন থেকে বন তুলে ফেলা যায় না । রবীন্দ্রনাথ, জীবনে ৫০ বার অন্তত তুষারপাত দেখেছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন অনেক দেশে কিন্তু তাঁর কোন কবিতায় সেই সব দেশের সেই সব অনুষঙ্গের কোন ছোঁয়া নেই, সেখানে শুধুই বাংলার মুখ – এ অভিযোগ আমার নয়, অকুন্ঠ রবীন্দ্রানুরাগী সৈয়দ মুজতবা আলি সাহেবের । আমার ব্যক্তিগত মতে, যদি রবীন্দ্রনাথ তা করতেন তাহলে হয়তো আরো কিছু অনন্য সৃষ্টি বাংলাভাষায় হতে পারত (আমার ব্যক্তিগত মতে বাংলাভাষায় আজো রবীন্দ্রনাথ সর্বাপেক্ষা মেধা/ মণীষার কবি – তাঁর ভাষা প্রতিষ্ঠিত হলেও রবীন্দ্রোত্তর কবিতায় তাঁর মননের উত্তরাধিকার খুব বিক্ষিপ্ত ভাবে কদাচিৎ চোখে পড়ে – এ দুঃখ যাবার নয় ) । তো, অমিয় চক্রবর্তী শুরু করলেন সেই ধারা (অমিয় চক্রবর্তী আজো সেই হাতে গোনা প্রাসঙ্গিক কবিদের একজন, যিনি কিছুটা হলেও উত্তর রাবীন্দ্রিক কবিতায় স্বতন্ত্র মনন ও দর্শনের দাবী মেটাতে সক্ষম বলে মনে হয় ) ।

“সাক্ষাৎ সন্ধান এই পেয়েছো কি ৩-টে ২৫-এ ?
বিকেলের উইলো-বনে রেড অ্যারো ট্রেনের হুইসিল
শব্দশেষ ছুঁচে গাঁথে দূর শুন্যে দ্রুত ধোঁয়া নীল ;
মার্কিন ডাঙার বুকে ঝোড়ো অবসান গেল মিশে ।।
অবসান গেল মিশে ।।

(ওক্লাহোমা; অমিয় চক্রবর্তী)

একটা রেশ থেকে গেলেও এই প্রথম পর্যায়ের ডায়াস্পোরিক ভূকাব্যিকতা ভ্রমণের ছোঁয়া মুক্ত নয় । এক ট্যুরিস্টের জবানী বলে মনে হতেও পারে ।

আর একটা কবিতা পড়ি –

বন (আর্যনীল মুখোপাধ্যায়)

জুতোর দোকানের সামনেই বনের বর্ণনা জুতো আঁটতে আঁটতে
আমাদের পাহাড়ী সেলুন থেকে চুল কাটার মাঝখানেও নিচের বনানী
বাড়ীর পেছনে ও জন্মদিনে বন, বিবাহবার্ষিকীতেও
বন থেকে বেরুলো ছেলে
বনের ছাতি ফাটিয়ে ফেলে

বিমর্ষতা কাটানোর যেখানে একমাত্র বেঞ্চ
সেই চুড়ো থেকেও নিচে নদীর দুপাশে বনমাথা
ভেবে দেখেছি কতগুলো বনের রূপক !

হাঁটতে হাঁটতে পড়লো “অ্যান্ডারসন হাঁটাপথ”
লাল শেয়ালটা হঠাৎ স্থাণুবৎ জুড়ে চোখের মণি
তার সাথে চোখের চেনাচিনিতে নতুন ভাষা হলো
জিম শুনে আকর্ণ হাসে, আহ্লাদ করে
এবছর তাহলে কম হরিণেরা লাল শেয়ালের কারণেই
ভালো হলো ! ওর বাগানে জিম সদ্য পয়েন্সেটিয়া লাগিয়েছে

প্রথম দু’স্তবক বর্ণনার “ভেবে দেখেছি কতগুলো বনের রূপক ! “ বাদ দিলে । বাঙালি সত্তাও পূরোদস্তুর –
বন থেকে বেরুলো ছেলে
বনের ছাতি ফাটিয়ে ফেলে

তাই টুরিস্টের কলমে বলে মনে হওয়াও থেকে যায় । প্রকৃত ভূকাব্যিকতা ধরা পড়ে শেষ স্তবকে, বাঙ্গালির চির নান্দনিক হরিণ, আদ্যন্ত রোমান্টিকতার হরিণ – তার সংখ্যা কমে যাওয়ায় কোন খেদ নেই বলে । বাঙ্গালির হরিণ তো আর নুইসেন্স নয় ।

কাল রাতে আর্যনীলের সাথে কথা হলো – ও বলল এরকম তো ভেবে লিখিনি । অটোমেটিক এসেছিল । এই অটোমেটিক চলে আসাই স্বতস্ফূর্ত নান্দনিক বদলের, পালা বদলের । ভুলবেন না সেখানে এক আদ্যন্ত বাঙালি বেড়াও রয়েছে “ বন থেকে বেরুলো ছেলে/ বনের ছাতি ফাটিয়ে ফেলে ।

পুনশ্চ ; কিছুক্ষন আগে অর্ঘ্য কমেন্ট করলো -- আর ভূকাব্যিকতার পাঠক বাঙলায় কয়টা তৈরি হতে পেরেছে ? বাঙলা কবিতা পড়লেই আমাদের সাহিত্য প্রতিবেদকরা এবং মহামান্য আলোচকেরা সবার আগের নিজেদের প্রশ্ন করেন - এই কবিতা বাঙ্গালীর আর্থসামাজিক অবস্থা, বাঙালীত্ব, লোকসাহিত্য ইত্যাদি ইত্যাদির কোন দিক উপস্থাপন করছে? এই কবিতা কি 'আমাদের' কবিতা? - "জিওপোয়েট্রি" ওইখানেই বাদ ।

(থ্যাঙ্ক ইউ অর্ঘ্য – এই পয়েন্ট-টা লেখার আগে মাথায় ছিল না । )

পানুর মনে হলো – হায় কবিতা – তাহলে বাঙ্গালীর নিজস্ব কুয়োর দলিল ছাড়া, ব্যবহারিক জীবনের উপযোগীতা ছাড়া তুমি নেই ।

“জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি
জুটে যায় যদি দুইটি পয়সা
ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী”

(হজরত মুহম্মদের বয়ান ; সত্যেন দত্তর তর্জমায়)

ব্যবহারিক বাঙালি, ফুলটি কোন, ফুল বাংলার ফুল কি-না, সেই নিয়ে চিন্তায় নিবিষ্ট হতে পারেন । আবার শেষ লাইনে তবে “বাধাকপি কিনো, হে অনুরাগী” বসিয়ে নিতে পারেন, চিবোবার জন্য ঠিক, পুষ্টিকর ও প্রচুর গ্যাসবর্ধক । তবে যে তরি তরকারি পাতে পড়ে স্যার একবার অভিধান খুলে দেখে নিয়েন তা দেশীয় কি-না ! যা শুনেছি, আলু বেগুন সবই বিদেশী । জাত না যায় !

যাই হোক বাঙ্গালির ব্যবহারিক/ বাণিজ্যিক মূল্য ছাড়া তাহলে নান্দনিকতাও হাওয়া । নন্দনতত্ব গরুর খাদ্য মাত্র । গরু, গোবর ও ঘুঁটে এই তিন বাঙ্গালির নিজস্ব দেশীয় । বেশ পরের বার মরোপোয়েটিক্স, গোবর ও ঘুঁটে নিয়ে আলোচনা করা যাবে ।

Friday, June 3, 2011

কেদার ভাদুড়ীর কবিতা

কেদার ভাদুড়ী নিয়ে জিজ্ঞাসার জন্ম বন্ধু বাল্মিকী’র সুবাদে । বাল্মিকীর মতে বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ট কবি । বহু খোঁজ করি, কে কেদার ভাদুড়ী, কবে লিখতেন । কোথাও খোঁজ পাই নি । অবশেষে মনে হলো তিসমার খান-এর মত, আমেরিকার মত – কেদার একটি মীথ মাত্র । শুভ্র, মানে আমাদের শুভ্র বন্দোপাধ্যায়কে জানাতে শুভ্র বললো –কেদার ভাদুড়ী-কে চেনো না ? বাংলা কবিতার জগতে সব চেয়ে বর্ণময় চরিত্র । উনি, টেলিফোন অপারেটরের চাকরী করতেন ব্রিটিশ এয়ারফোর্সে, তারপর আমেরিকান এয়ারফোর্সে, নৌ-বিদ্রোহের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন – তাঁর প্রত্যেকটি চাকরীই যায় ইনসাবর্ডিনেশান অথবা কোন না কোন প্রতিষ্ঠান বিরোধী কার্যকলাপের জন্য । কলকাতা যাচ্ছি, শুভ্র’র সাথে একবার মনীন্দ্র বাবুর (গুপ্ত) সাথে দেখা করব – উনি কেদার ভাদুড়ীর সব খবর রাখেন । ততক্ষণ এই দু’টি কবিতা পড়ুন ।

ময়ূর

বেশ মনে আছে, বাবা একবার এক ময়ূর পুষেছিলো ।
কারণ ? বাড়িতে গোখরো সাপের বড়ো আনাগোনা, তাই ।
বাবা ওকে কিছুই খেতে দিতো না, তবুও
বর্ষাকাল এলে ফুলে ঢোল, পেখমে পেখমে ছয়লাপ ।

তবে সবসময়ে নয়, মা কাছে গেলে তবেই
এমন পেখম মেলে দিতো, দাঁড়াতো, নাছতো, দেখবার ... ।
প্রথমে বুঝিনি আমি ও বাবা, মা লজ্জায়
বুকের আঁচল টেনে দিয়ে আড়ালে যেতেই, যার নাম রেখেছিলো কাত্তিক ঠাকুর ।

জীবনে এর চেয়েও বড় দেহভোগ, সৌন্দর্যশিকারী (ভিখারি)
কখনো দেখিনি । আমি মার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে ...

মনে করতো বুঝি স্নেহপরবশ হ’য়ে গেছি আমি
কিন্তু বাবা একদিন রাগে দোনলা বন্দুক নিয়ে গুলি করতেই মা,
যে কোনোদিন বাবার নাম মুখে আনেনি
বলে উঠলো ; রা ঘ ব রা ঘ ব !
আর আমি এই কালকুট্টায় পালিয়ে এসে হবনব হবনব ক’রে
নাম নিয়েছি সৌরভ ! বোঝো !


শেষ প্রেম

যুদ্ধে যাবো কাল । আজ এই হিমসিম ভয়ার্ত সন্ধায় আমি
গৌরবের জয়গাথা পড়ে যাবো শুধু ? নাকি ইতি-
হাস ঘেঁটেঘুটে মিশরীয় সভ্যতার ফ্যারাও আমল থেকে
অ্যাসিরীয়, ব্যবিলনীয়, চৈনিক, মহেঞ্জোদারোর
স্পার্টান পদ্ধতি জেনে নেকড়ে ও রোমুলাস, রোম ... মহাব্যোম
থেকে ফিরে আসে হ্রীং । টেন্টের দরোজায় দেখি পিয়া, অলিম্পিয়া,
আমারই যুদ্ধের ঘুড়ি মদ্য চায়, তার চিহ্ন চক্ষুতে, নাসায়
নিতম্বে উন্মুখ ।

আমি তাই দুই কাস্ক মদ্য নিয়ে ওর সামনে রেখে
বলে উঠি, খা । ও খেলো, খেয়ে নিঃশেষে ফতুর করে দিলো পিপে ।
আমি ওর গা টিপে গা টিপে চুমোয় ভরে দি’ যোনি,
রহস্যের ঘ্রাণ, যা খাজুরাহোর মন্দিরে অক্ষত
আছে আজো, আর বিংশশতাব্দীর এই কালচক্র
শিল্প শিল্প ব’লে ঐতিহাসিকের ক্ষুধা, যদি দুষ্ট, আণবিক
কাল যুদ্ধে যাবো, বর্শাবিদ্ধ মরে যাবো, প’ড়ে যাবো ঘুড়ির পায়ের ক্ষুরে
মৃত্যুর অধিক ।

Thursday, June 2, 2011

কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের কবিতা

কৃষ্ণগোপাল মল্লিক কিছুই লিখতেন না সম্ভবত তাঁর পঞ্চান্ন বছরের আগে । প্রথম যৌবনে স্টেটসম্যানে চাকরী করতেন । ফিনফিনে বাবু -- ক্যালিকো ধুতি, ব্রীল ক্রীম । চাকরী ছাড়লেন, লুঙ্গি ধরলেন আর এই বেশেই তাঁর হিল্লি (দিল্লি তিনি কদাপি যান নাই, একবার বর্মায় গেছিলেন ) । কৃষ্ণগোপাল একটি প্রেস চালাতেন, আর একটি প্রকাশনী—অধুনা – যেখান থেকে বেরোত ত্রেতা যুগের ব্লকবাস্টার পত্রিকা “গল্প কবিতা” । সন্দীপন চাটুজ্জের সাথে তাঁর লড়াই ও কৃষ্ণগোপালের বাড়ির সামনে সন্দীপনের খেয়েদেয়ে আমরণ অনশনের গল্পও আজ প্রবাদ । হঠাৎ কেষ্টদা গল্প লিখতে শুরু করলেন, উপন্যাস এবং কী লেখা ! অসাধারণ উইট, রস আর উত্তর কলকাতার ইতিহাস ও ভূগোলের ওতপ্রোত জ্ঞান, মজলিশি অথরিটি – “আমার প্রেমিকারা”, “পথে চলাই দায়”...। কেষ্টদা কবিতাও লিখলেন । নীচে তাঁর দুটি কবিতা—

ভূমিকা

ভাষা আমার চাকর
আর, শব্দগুলো কুকুর ।
ভাষা আমার পা টিপবে জল গড়াবে
বললে তামাক সাজিয়ে দেবে ;
শব্দগুলো, তু করলে, আসবে ছুটে
যেখানে থাক – দোরগোড়া বা ছাদের মাথায়


বয়স্য

আমি জেনেছি
মানে, কথাপ্রসঙ্গে জানা গেছে
স্যান্সক্রিট স্কুলের হেডমাষ্টার সুজিত দাশ
ভিস্তিপাড়ার হোমিও ডাক্তার এন সি দে
কবি উৎপলকুমার বসু
ছাপা-কারবারী আমার মতো ১৯৩৬-এ জন্মেছেন
অর্থাৎ, ১৯৩৬-এ আমরা সকলেই মায়ের দুধ খেয়েছি
সুজিত দাশ একটু আগে ভাগে, আর এন সি দে একটু দেরি করে
তবে, ১৯৩৭-এ চারজনই হামা টেনেছে
যথাক্রমে ফরিদপুর, ঘাটশীলা, রাণাঘাট আর কলকাতায়
এবং ’৪৬-এর রায়টে চারজনেই খুব ভয় পেয়েছিল
নার্ভাস ফিভারও – জ্বর উঠতো ১০০ কি ১০১ । ......
১৯৫৫ নাগাদ যে যার আই এ / আই এস সি সেরে ফেলে
হাঁটা দিলে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্ছিম – আর
বছর কয়েকের মধ্যেই নেমে পড়লো দু’পয়সা কামাতে ......
কালক্রমে, কেউ কারো প্রীতিভোজে নেমন্তন্ন না খেয়েও
সকলেই বিয়ে-থা করে ঘর-সংসার শুরু করে দিলে ......
তারপর সবই যার যার তার তার মতো ।
শুধু, ওবছর, দ্যাট মীনস, ‘৮৬তে সকলেরই বাড়ির লোক
এক একটা দিন বললে
‘আজ তোমায় একটু পায়েস খেতে হবে, আজ তোমার ৫০ ভর্তি হলো”
লাজুক লাজুক মুখে আমরা পায়েস খেলাম ।

কোথায় যেন পড়েছিলুম—রূপাঞ্জলি না রূপমঞ্চে---
আমাদের উঠতি-বয়েসের দিল-কি-রাণী বোম্বের মধুবালা
সে_ও নাকি জন্মেছিল ঐ ১৯৩৬-এই......
মধুবালা, কিছুদিন হলো মারা গেছে ।

স্পৃহা

নিজের কাছেই ফিরে আসি
ঘাড় গুঁজে বসে আছে দিশা ও বিদিশা
খুব রাত্রি হয়
ঝিম ধ’রে গোটানো কপাটে

আঙ্গুল থেকে ছাড়িয়ে আনি জড়তা
শাদা প্লেটে রাখি
মূল্যবান করি

ভোর হয়
আলো ছপছপ ক’রে ঢোকে আমার প্রতিবিম্ব
তার প্রকাশ ভঙ্গিমা
ভাবি কোথায় লেগেছে অসামান্য আলস্যঋতু

যাবতীয় মৌল, মৌলের অকারণগুলি
ফিরে এল
তবু মায়াটি এল না

দু’একটা দেখার মধ্যে বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকে
দু’একটা শোনার ভেতর চলে যাওয়ার শব্দ

প্রতিধবনির মধ্যে ঢুকে যাই
বেজে উঠি ফাঁকা মানুষের নিরালম্ব স্পৃহা

Wednesday, June 1, 2011

নুন

এরপর দৃশ্য বন্ধ করে
ঢুকে পড়ি পাতার ভেতর
রিপু বেয়ে আন্দাজ ওঠে

দেখার ভেতর সেভাবে থাকার কথা ছিলো না
চেনার মত শুকনো স্বল্পতা
ঘুরে বসাবার মত কোল



খুব দূরে চলে গেছে যাওয়া
যাওয়ার হাত ধরে পরিষ্কার চলে গেছে মন
ভাবনার চোখে অন্য কে আর তেমন ভাব

কুলিয়ে ওঠার মত নুন