“নতুন জিভের মত অল্পলাল ভাষাটা
আমাকে দাও
আমাকে দেখাও পাথরের পৃথিবীতে জ্বলছে নিভছে আলো
দূরে ---অন্ধকারে জল—তার প্রবাহ আমাকে দেখাও ।
চলে যায় সুখের শব্দ তার টানা শব্দ কোন আকাশে যায়
কেন সুন্দর কেন সুন্দর এত একটি মুনিয়া তার শাদা ডিম
ওই নতুন ট্রাইসিকলের সারা রাস্তা সোনার তারের মত শব্দ
ওই কীটপতঙ্গ যারা শব্দ করে – জঙ্গলে শরতে, মধ্যখানে
যে মাঠ ময়দান এমন ভুবন ও তার আকাশ দেখে দেখে পাগল
যারা, যারা চুপ করে আলো দিয়ে যায় ময়দানবের মত
ওই সব আমার সাজমহল দূরে, দুঃখে, তারায়
ওইতো একটু শীতের ঘাম জড়িয়ে আছে আকবরের তারে”
স্বদেশ সেনকে চাক্ষুষ একবারই দেখি । তেমন কিছু মনে নেই,
কারণ চোখ ফেটে জল এসেছিল, বুকের ভেতর কষ্ট হচ্ছিল, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোতে চাইছিল
না । এতটুকু মনে আছে, স্বদেশ সেন বাকপটু নন, ধীরে কথা বলেন, বলার চেয়ে শোনেন বেশি,
সাধারণ, সৌম্য, শান্ত চেহারা—আর হ্যাঁ, সিগারেট
অফার করেছিলেন । যদ্দুর জানি একই অবস্থা অরূপরতন ঘোষেরও হয় । পরে নিজেকে প্রশ্ন
করি—কেন ? কি আছে স্বদেশ সেন-এ ? বারীন, উচ্চকিত
পরীক্ষায়, মৌলিক চিন্তায় উদ্ভাসিত । কমল, শংকর এক একটি অ্যাডভেঞ্চার ! কিন্তু
স্বদেশ তো একজন নিপাট সাধারণ, নিপাট মধ্যবিত্ত, যাঁর চারপাশ আমাদের চেনা ঘরোয়ায়,
সচরাচরে—একটু মনোযোগ নিয়ে বসা
সম্পর্কের পাশে, একটু সুখদুঃখের কথা পথচলতি হাটুরের সাথে, পরিচিত নাম ধরে ডাকা,
একটু ভালো থাকা, একটু মনখারাপ – কোথাও কোন চাতুর্য্য
নেই, ছল নেই, কপট নেই । সংস্কার আছে, কিন্তু সেই সংস্কার কখনো বেড়ি হয়ে ওঠে না ।
এই কী আদর্শ মধ্যবিত্ত ! বাঙালি মধ্যবিত্তের তো অনেক সমস্যা, এলিটিস্ট হয়ে ওঠার
স্পৃহা, অথচ সংস্কার থেকে বেরোতে না পারার অক্ষমতা—সে
অনেক অনেক দিন রয়ে সয়ে, অনেক রং পছন্দ করে ফ্রীজ কেনে, আলমারি কেনে তারপর তাকে
সস্তার প্লাস্টিকে ঢেকে রাখে । যেন অর্জন করা এক বড় ব্যাপার কিন্তু তারো চেয়ে বড়
অর্জিতকে সঞ্চয় করা, আর এই সঞ্চয়প্রবণতা যদি অর্জিতকে ঢেকে রাখে, অন্ধকারে রাখে
তাও সই । এ বড় দ্বিধার জীবন, বড় কষ্টকর । বছরে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে গিয়ে,
সেদ্ধভাত খেয়ে কাটানো । সে আজো রবীন্দ্র নজরুলের বাইরে বেরোতে অক্ষম, ডাক আসে,
ভালো লাগে অন্যকিছুও কিন্তু সেসমস্ত ভালো লাগা যদি কুপ্রভাব হয় ? যদি সংস্কারকে
লঙ্ঘন করে ? সংস্কার মধ্যবিত্তের শেকল । অথচ সংস্কারই মধ্যবিত্তের সুস্থতা, ঠাঁই,
জীবন যদি দ্রুতির মধ্যে হারিয়ে যায়—সংস্কারই সেই ঠাঁই যা
নিজের কাছে নিজেকে ফিরিয়ে আনে, মাথায় জলকাপড় দেয়, আর নিরাময় গাঢ় হয়ে ওঠে ।
স্বদেশকে সেই সর্বগুণসম্পন্ন পিতার মত মনে হয়, যিনি ঘরের চাল ছাওয়ান, মমতায় বাগান
করেন, উঠোনের খাটিয়া নিজের হাতে বাঁধেন, ছেলেমেয়েদের পড়ান, আনন্দ পান সমস্ত সবে,
খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেন ক্ষুদ্রের কৌশল, আর অন্তরকে ভরে তোলেন, নান্দনিকতায়, যে
নান্দনিকতা সচরাচর বাঙ্গালির মত পূঁথি বা ইন্সটিটিউশান মারফৎ প্রাপ্ত নয় । যা
তীব্র ভাবে নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও বোধ থেকে গড়ে ওঠা, অর্জিত । সেখানে “চালতার
পচা”-ও মায়াতুর, বাতাবীফলের মধ্যে খোকনের মুখ,
ময়মনসিঙ্ঘের ছেলের হেরে যাওয়ার স্টাইল মুখ্য হয়ে ওঠে নাগরিক সমস্ত জয়কে ছাপিয়ে,
ডাঁটো হয় পোয়াতি ডালিমগাছ আর কোথাও বুলবুল বুলবুল শব্দে দুধ ফেটে যায় । স্বদেশ
গভীর, স্বদেশ দক্ষ, স্বদেশ পারঙ্গম, স্বদেশ এক অত্যন্ত চিন্তাশী্ল সামাজিক, রাজনৈতিক
সচেতন, দার্শনিক, ভাষাবিদ যিনি ভাষাকে অবলীলায় ব্যবহার করেন ভাবকে এক দিক থেকে
অন্য প্রবাহে বইয়ে দিতে, অথচ স্বদেশ চাতুরী জানেন না জানতেই পারেন না । তিনি হেটো,
মেঠো শব্দকে পরম মমতায় তোলেন, শহুরে শব্দের পাশে বসান এতো যত্নে, একটি কবিতা
পুরোপুরি সেই পরিপাটি যত্নের, সুশ্রূষার ছবি হয়ে থাকে । এ তো গেল সংস্কারের কথা, সচরাচরের
কথা কিন্তু স্বদেশ এইখানেই আটকে থাকেন না, তিনি তো আর যেমন তেমন মধ্যবিত্ত নন ।
তাঁর ব্যক্তিগত নির্মল সংস্কারকে তিনি সুক্ষ ও সামান্য ডিকশানের বদলের মধ্য দিয়ে
চারিয়ে দেন, আর কোথাও ব্যক্তিগত বিশ্ব ধারণ করে মহাবিশ্বকে, গ্রহণ করে মহাবিশ্বকে,
তাকে নতুন মানে দেয়, নতুন রং । প্রবল বোদ্ধা না হলে, প্রচূর জীবনবোধ ও ভালবাসা না
থাকলে এ সম্ভব হয় না, হতে পারে না । যেখানে যতটুকু ভালো, যেখানে যতটুকু কুৎসিতের
মধ্যেও সুন্দরের সম্ভাবনাটুকু থাকে স্বদেশ সেটুকু বেছে বেছে তোলেন—আমাদের
দেখান । মানুষের ইডিওসিনক্র্যাসিতেও বিরক্ত না হওয়া, ধৈর্য ধরে তাকে বোঝা, তার
সম্ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে তোলা—এ, এক আদ্যপান্ত
মধ্যবিত্ত ছাড়া হয়তো সম্ভব নয় । ঈশ্বর বলে কোথাও যদি কিছু থাকে, সেও যে এক যুগপৎ
সংস্কারশীল ও সংস্কারহীন মধ্যবিত্ত—স্বদেশকে দেখলে, পড়লে
তাই মনে হয় । তাই হয়তো সেইদিনের চোখ ফেটে জল, বুকের ভেতরের ভারী কষ্ট ।
মাঝে মাঝে মনে হয় আর্ট দু’ধরণের
। একটি টিস্যু-কালচার প্লেটে যখন কোন কোষের মোনো-লেয়ার কালচার করা হয়, তখন তাতে
থাকে কোষ ও দুটি পাশাপাশি কোষের মাঝখানের জায়গা ভরাট করে রাখে একস্ট্রা সেলুলার
মেট্রিক্স, যা মূলত বিভিন্ন প্রোটিন দিয়ে তৈরী । যদিও টেকনিক্যালি তা জীবন্ত নয়,
তবুও সে দুটি কোষের মাঝে কমিউনিকেশানের অন্যতম মাধ্যম । মনে হয়, দুটি মানুষের
মধ্যেও এরকমই এক মেট্রিক্স রয়েছে, মাকড়সার জালের মতো, গোটা একটি পাড়ায়, মুহল্লায়,
শহরে, রাজ্যে দেশে । একধরণের আর্ট এই মেট্রিক্সে দোলা দেয়, সেই তরঙ্গ ছড়িয়ে যায়
মানুষ থেকে মানুষে আর তা গৃহিত হয়, উৎসবে পরিণত হয় । আর দ্বিতীয় ধরণের আর্ট অন্তরচারী,
সে কখন সটান ঢুকে যায় মানুষের ব্যক্তিগত বিজনে, চুপচাপ বসে থাকে কাউকে বিরক্ত না
করে, কোন দাবি ছাড়া, মানুষ যখন সমস্ত উৎসব শেষ হলে ঘরে ফেরে, নিজের কাছে, তাকে দেখা যায়, দেখতে পায় কেউ অনেকে আর গোটা
পৃথিবী গৌন হয়ে যায় ।
আমি প্রথম পড়ি “মাটিতে দুধের কাপ”, “রাখা
হয়েছে কমলালেবু” শেষ হয়ে গেছে—এমত
জানিয়েছিল বারীনদা, সে বইয়ের কিছু কবিতা পড়ি “ঝর্ণাকলম”-এ
। মুগ্ধ ও বিপর্যস্ত হয়ে যাই, নাকাল হয়ে যাই –
নিজে কী করতে পারবো না সারাজীবনেও, সে সম্পর্কে অবহিত হই । আজো সবচেয়ে বিস্ময়কর
লাগে, সেই সময়ই চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে গিয়েও স্বদেশ—এগিয়ে
যাওয়ার কথা ভোলেন না । পোস্টমর্ডান বিপর্যয়ের পর, গোটা পৃথিবীর আইডেন্টিটি
ক্রাইসিস-এর সময়, স্বদেশ আবার একটি নতুন ডিকশানের দিকে এগিয়ে যান । স্বদেশ-এর
পরবর্তী পর্যায়ের কবিতা “ছায়ায় আসিও”
যথারীতি, হজম করতে কষ্ট হয় কিছু দিন, মনে হয়, ঐ চূড়ান্ত সফল ঈশ্বরের জায়গা থেকে
নতুন পরিক্রমণের জন্য নীচে নেমে আসার প্রয়োজন কী ছিল ? কী দরকার ছিল নতুন পথে
হাঁটার চেষ্টা চালানোর ?
স্বদেশ বোধ হয় মুচকি হেসেছিলেন । হঠাৎ অন্য এক স্বদেশ সেন-এর
আত্মপ্রকাশ হয় । “রাখা হয়েছে কমলালেবুর স্বদেশ”
বিষয়বান কবিতা লিখতেন, মধ্যবিত্ত বিষয়ে-আশয়ে সম্পৃক্ত ছোট ছোট সুন্দর, ছোট ছোট
অনুভূতিকে নিজস্ব বয়ানে, ডিকশানে, ছোট্ট ছোট্ট মোচড়ে গড়ে তুলতেন সম্পূর্ণ একটি
কবিতা—যা বিষয়ী হলেও মূলত আবহের, আদ্যন্ত দার্শনিক, গভীর
অথচ সুন্দরের সাথে শান্ততার সাথে যার কোন বিবাদ নেই, আপাতদৃষ্টিতে সরল, গভীরপাঠে
গভীরতর । এই সময়ের কবিতাগুলির মধ্যে দেখা যায় এক কেন্দ্রাতিগ ঝোঁক, এক বিন্দু থেকে
ছড়িয়ে যাওয়া ভাবনাজাল যা বিন্দুটিকে ঝাপসা করে এক আবহের সৃষ্টি করে । “মাটিতে
দুধের কাপ”-এর স্বদেশ সামান্য আলাদা, এই
স্বদেশ পংক্তিভিত্তিক, ছোট ছোট আলাদা আলাদা অস্তিত্বের লোকাল সত্যকে লেখা ও তাদের
বৃহত্তর করে তোলা একই কবিতায় । “ছায়াতে আসিও”
পর্যায়ে স্বদেশ বেশ কিছু গদ্য ফর্মে লেখেন – কিন্তু ফর্ম বাদ
দিলেও, তাঁর কন্টেন্ট আলাদা হতে থাকে এইখান থেকে । স্বদেশের আজকালকার কবিতায় অজস্র
অনুভূতি ও উপলব্ধি আসে, সঙ্গে সঙ্গে সমীচিন হয়ে আসে দ্বিধা কিন্তু এই স্বদেশ নিজের
দ্বিধাকে গোপন করেন না । যেন নিজেকেই প্রশ্ন করেন, নিজেকেই উত্তর । ছোট, ছোট পায়ে
উপলব্ধি আসে, তাদের তুলে নেন লেখেন আবার কন্ট্রাডিক্ট করেন । অমিল গাঢ় হয়,
বিক্ষিপ্তি আসে, বিক্ষিপ্তির হাত ধরে দ্রুতি, কবিতা এক ধাবমান কুয়াশা হয়ে ওঠে ।
রহস্যময়তার মধ্যে চারিয়ে দেন বীজ, আলো পোঁতেন, অন্ধকার পোঁতেন, এমনকী নিজের
বিরক্তিটুকু, শ্লেষটুকুকেও আর অবহেলা করেন না । স্বদেশ নিজের ঈশ্বরত্বের সীট ছেড়ে
নেমে পড়েন পরীক্ষায়, নতুনের খোঁজে । আর কোন কবির কথা জানিনা, যিনি প্রথাগত কবিতায়
চূড়ান্ত পারঙ্গম হয়েও, তাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পরেও নতুন কিছু লিখতে হবে
বলে আবার পরীক্ষায় নামেন – এমন কী রুক্ষ, কর্কশ
হয়ে উঠতেও দ্বিধা করেন না । আর বিষয়, স্বদেশের এখনকার কবিতায় বিষয় বলে কোন কিছু
খুঁজে পাওয়া যায় না—যদি জোর করে তাকে একটি বিষয়ের
শ্রেণীভূক্ত করতেই হয়, আমার মনে হয় স্বদেশের এখনকার সমস্ত কবিতাই “কবিতা”
সম্পর্কিত, এক উৎকর্ষের খোঁজ, ব্যক্তিগত ফিল্টার পার হয়ে আসা আলোয় কবিতা নামক
আর্টফর্মের নানাদিক স্পষ্ট করে তোলা । আমার ব্যক্তিগত পছন্দের স্বদেশের এখনকার
একটি অন্যতম কর্কশ (অথচ নিরীক্ষার চূড়ান্ত কবিতা) কবিতা পড়া যাক ।
মামলা-গাছ//
গতিময় ভালোবাসা দেখবো
সামনে বা মুকুটের পেছন থেকে
দাঁড়াবো বাতামতলির ভর হয়ে
হয়তো উদাস থাকবো
আমি লটবহর নামক বস্তু
একদিন ভালোবাসার গতিময়তা দেখবে বা
যত মহাবীর তার ইঁদুর শিকার
উত্তরের বদলে ইয়েগুলো শুনি
সদা মূর্খের ত ত
ট্রেনের মত বারীনের ভেলভেট পোকা
বস্তুতে পেছল পায়ে চলে গেলো
বুনো চকচকে রক্ত লাইনে
শেষ পর্যন্ত মুখের পাউডারটুকুই থাকলো
জীবনময় করেছো সেই ফুল দেখাও
একটা জীবনময় দেখা
কোনোদিন দেখা হয়নি ব’লে না দেখাকে
দেখো
মালঞ্চের বন
বুদবুদময় ওরা কার ছেলে মেয়ে
জল আর সাবানের মিশুকে চরিত্রও কত দেখলাম
জানাজানির কানে শোনা
কত দেখলাম
অমর প্রাণের মামলা-গাছ ।
প্রশ্ন হয়, মামলা-গাছ কী ? স্বদেশের বহু কবিতায় এরকম
অনেক এলিমেন্টস পাই যা সচরাচরের সত্য নয়, যেমন “কাবেরী পাখী”, “বেহালা-কাঠের গাছ” (নানা ধরণের গাছের কাঠ বেহালা
বানাতে ব্যবহার করা হয় যথা, মেপল, স্প্রুস, রোজউড, মেহগনি ইত্যাদি । শুধু তাই নয়
বেহালার বিভিন্ন অংশের জন্য বিভিন্ন কাঠের প্রয়োজন হয়, সেখানে একটি গাছকে
বেহালাগাছ বলে চিহ্নিত করা—তথ্যের দিক থেকে অসত্য হলেও তা কবিতার অন্যান্য অনুসঙ্গের
সাথে মিশে এক অদ্ভূত সৃষ্টি হয়ে দাঁড়িয়ে যায় – যেন ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার অন্যতম
শর্তই হয়ে দাঁড়ায় বেহালাকাঠের গাছগুলিকে চিনে নেয়া, আবিষ্কার করা ।) মামলা-গাছ কী
তবে চেনা কোর্টচত্ত্বরে কোন ছড়ানো অশ্বত্থ, বট যার তলে মুন্সী, উকিল, কপিরাইটার ?
না-কী মামলা বলতে এক ঘটনা যার ডালপালা প্রসারিত । অথবা মামলা-গাছ এক সিচুয়েশনাল
সহাবস্থানের জায়গা । আমার এই তৃতীয় সম্ভাবনাকেই শ্রেয় মনে হয় আর এই রাস্তা ধরেই
পাই কখনো সিচুয়েশনাল ভরকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে, কখনো রাজার চোখে, কখনো প্রজার চোখে, কখনো
অবহেলায় পড়ে থাকা লটবহরের চোখে সম্পর্কের রকমফের । স্বদেশ এক গতিময় ভালোবাসার কথা
তোলেন, বার বার বলেন তাকে দেখার কথা বিভিন্ন অবস্থান থেকে । আবার জীবনময় যে ফুল
বোয়া, তাকেও দেখার বলেন । আমার নিজস্ব মধ্যবিত্ত শেকড়ে টান পড়ে, আনাচ কানাচে একটা
উচাটন হয়, সিগারেট হাতে ব্যালকনিতে দাঁড়াই—এখন
খানিক রাত, কলোনির বৌ-ঝিরা মাঠে, এক কোনে আলো, একটা গ্রুপ তারস্বরে শাশুড়ি-নিন্দা,
সোপ– অন্যদিকে মাঝে সাঝেই হুল্লোড়, মনে হয় ট্যাম্বোলা চলছে ।
ছোট ছোট দু’জোড়া হাত হাঁটু জড়িয়ে ধরে আমার দুই জমজ, ১৪ মাসের, কোকো
রোরো – শাঁখের আওয়াজ শুনিনি আজ দীর্ঘদিন, পাশেই তুলসীমঞ্চ, গরমে
পুড়ে যাওয়া তুলসী গাছ । ব্যস্ততা, দৌড় । এই ব্যস্ততাই কী সম্পর্ককে ডায়নামিক করে
তোলে ? তার রোমাঞ্চ বাড়ে হয়তো, কিন্তু স্নিগ্ধতা ? বারীন ঘোষালের ভেলভেট পোকার
ট্রেনের উল্লেখে আবার পড়তে ইচ্ছে হয় – পড়ি –
“যা
একদিন মনে হয়েছিল লাল ভেলভেট পোকা, হাতে তোলা যাবে ঘাস থেকে বা দেশলাই বাক্সে পোরা যাবে তা আমার সঙ্গে বড় হয়ে উঠলোনা আর । সে ফিলিংটা কিন্তু রয়ে গেল, তা যে কোন মেয়ের গায়ে হাত দিলেই টের পাই । এর মধ্যে আবার কোন সম্পর্ক
টম্পর্কের কথা উঠিওনা অথবা
কলম ক্যারাটে শেখা গুন্ডা মেয়েদের কথা যারা যৌনতা জাগিয়ে ভালোবাসে বাক্সেরই দেশলাইগুলো ।
তা সেই ফিলিং-এর দিনে আমি মেঘচন্দ্র বা বোকালাল রাজনীতির
কথা ফুলবোনা । পাহাড় দেখতে যাবো না দৌড়ে, রাত জেগে ক্লাসিকাল শুনতে, অলোকের সাথে মদ নিয়ে বসতে যাবো না । ভেলভেট পোকারা চারপাশ থেকে আমাকে
বেড় দিয়ে চলতে শুরু করলে আমি একটা
শব্দও তো শুনতে পাব না । শব্দহীন একটা কবিতা শুধু অক্ষর দিয়ে সাজালে আমি ঐ মেয়েদের মধ্যেই গিয়ে পড়ি । শত্রুমিত্র যেই হও ব্যাপারটা কি
তোমরা সবাই এভাবেই টের পাও
। ভেলভেট পোকাদের ট্রেনে আমাকে দেখতে
পাচ্ছ কি ?”
আমার
১২ বছরের কথা মনে পড়ে । এই কবিতা প্রথম-পাঠেই ২০০৩-৪-এ আমাকে বারীনভক্ত করে
তুলেছিল । আমি সেই ভাগ্যবানদের একজন যারা সততই ভেলভেট পোকার ট্রেন দেখেছে । তখন
১২, হাজারিবাগ, মেরু, বিএসএফ ক্যাম্প, এক চিলতে ফাঁকা জায়গায় কোয়ার্টার, চার ধার
ঘিরে ঘনবন্ধন শালবন । বৃষ্টি পড়ে আর লাইন করে লাল ভেলভেট মাইট, দেশলাই বাক্সে
পোরা, বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখা, মাঝে মাঝে আঙ্গুল ছোঁয়ানো ভেলভেটে। পোকা জেনে
স্বভাবত একটা হাল্কা ঘিনঘিনে ভাব অথচ এক
নিবিড় ভালো লাগা । যুগপৎ আকর্ষন ও বিকর্ষন। বারীন বোহেম, সংস্কারমুক্ত তিনি ফিলিং
পুষে রাখেন, সম্পর্কের লেশমাত্র ছাড়া । স্বদেশ পরীক্ষায় নেমেও সমস্ত সম্পর্ক জিইয়ে রাখেন । এক কণা ফেলে দেওয়াতেও তাঁর আপত্তি
। পৃথিবীর ভালোবাসা যখন তার খোলস পাল্টাচ্ছে, অবস্থান বদলাচ্ছে, মানুষ আরও চতুর
হয়ে উঠছে, তখনো স্বদেশ সম্পর্ককে ধরে রাখেন, যা জীবনময়ের যা ক্রমাগত আকর্ষন ও
বিকর্ষনের টান-পোড়েনের থেকে বুনে ওঠা । ভালোবাসার দেখায় এক আবহ থাকে, যার মধ্যে
সম্পূর্ণ একটা মানুষ, আর অনেকটা অতিরিক্ত-- সম্পর্ক, স্মৃতি, কান্না, এমন কী শাকের
আঁটি, পিলসুজ, মশারির দড়ি, রোজদিনের আটপোরে, দু’একদিনের
বেনারসি, ব্রোচ । যে দেখায় শুধু অঙ্গ আর প্রসাধনটুকু থাকে—সে
দেখা কামুকের, সে দেখা ট্যুরিস্টের । যে দেখায় সম্পর্ক গড়ে ওঠে না সে দেখা অন্য
কারো, আর কারো ।
লিখতে
লিখতে ঘুমিয়ে পড়ি । সকালে অফিস, বাইক চালাতে চালাতে চোখ পড়ে—রাস্তা বাড়াতে গিয়ে কেটে ফেলা
অজস্র গাছ, কোনকোনটা হয়ত ২-৩০০ বছরের, কাগজের কথা মনে পড়ে, কবিতার কথা, প্রায়
অকারণেই মাথায় বাজে “জীবনময় করেছ সেই ফুল দেখাও” আর কবিতার কথা মনে হয় । তবে কী
স্বদেশের দেখা আদতে কবিতাকে দেখা, সময়ের
সাথে তার সম্পর্কগুলোকে দেখা ? “শেষ পর্যন্ত মুখের পাউডারটুকুই থাকলো” কী আসলে সারশূন্য কবিতার অলংকার ও গিমিকের রেফারেন্স আনা ।
বর্তমানের দ্রুতির পাল্লায় যত্রতত্র লেখা ফাস্টফুড কবিতা নিয়ে তাঁর আক্ষেপ?
রূপকাশ্রয় স্বদেশের
কবিতায় দেখা যায়, সেই প্রথম থেকেই, কিন্তু এই কবিতায়, এই পর্যায়ের কবিতায় তা
বহুমাত্রিক হয়ে যায়, মুশকিল হয় তার ঠাহর পাওয়া । একই কবিতায় এত মুড-- সুখ, আক্ষেপ,
কৈশোরিক আনন্দ, উপলব্ধি, সন্ধানের নির্দেশ ইত্যাদি একসাথে এমন অবলীলায় আসে –সে আর বুঁদ করে তোলে না – চাঞ্চল্য জাগায়, ভাবায়, স্নায়ুকে
উত্তেজিত করে, নতুন লেখার দিকে ঠেলে দেয় । এই তো চেয়েছিলাম, বুঁদ হয়ে অনেক থেকেছি
গীতিময়তায়—এবার দেখার সময়, ভাবার সময়—সম্পূর্ণ সচেতনতায় । আর ভাবতে অবাক
লাগে, যে কবি পরম্পরার প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস রেখে, তাকে মেনে নিয়েও এক সময় নিজেই
এক নতুন পরম্পরা হয়ে দাঁড়িয়ে যান, তিনি আজো এই অসুস্থ শরীর নিয়েও সেই আসন থেকে
নেমে এসে নতুন সন্ধানের রাস্তা নিজেই তৈরী করেন ।